Tashnuva Anan

News Anchor

Transgender Rights Activist

Model

Actress

Tashnuva Anan

News Anchor

Transgender Rights Activist

Model

Actress

Blog Post

মূলধারায় একজন শিল্পী তাসনুভা

October 13, 2021 English
মূলধারায় একজন শিল্পী তাসনুভা

একটা মোটরবাইকের খুব শখ ছোট ভাইয়ের। চাকরিজীবী বড় বোন সেটা বুঝতে পারেন। একদিন তিনিই ভাইকে জানান যে বাইক কিনে দেবেন। তবে তাঁর পছন্দে। ভাই তো হতাশ! বোনকে বাইকের মডেল দেখাতে চায়। কিন্তু বোন অনড়। নিজের পছন্দেই বাইক বেছে নেবেন। পরে দেখা যায় বোন যেটা কিনে দিলেন, সেটাই ভাইয়ের পছন্দ। খ্যাতনামা একটি মোটরবাইক কোম্পানির সাম্প্রতিক সময়ের বিজ্ঞাপনচিত্র। দর্শকেরাও পছন্দ করেছেন বিজ্ঞাপনটি। বিশেষ করে বড় বোনের চরিত্রটি।

এই বিজ্ঞাপনে বড় বোনের চরিত্রে দেখা গেছে তাসনুভা আনানকে। তিনি যখন ফেসবুকে বিজ্ঞাপনচিত্রটি দেন, সেখানে বেশ ইতিবাচক মন্তব্য দেখা যায়। ‘আপু, খুব ভালো’, ‘আপু, আপনার মতো বোন থাকা তো ভাগ্যের ব্যাপার’, কমেন্টগুলোর ভাষা এমনই। এর আগে শাড়ির একটি বিজ্ঞাপনেও দেখা গেছে তাসনুভাকে। আর চলতি বছরের ৮ মার্চ তো তৈরি করেন ইতিহাস। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বৈশাখীতে সংবাদ পাঠক হিসেবে কাজ শুরু করেন তাসনুভা আনান। ঘটনা ঐতিহাসিক এ কারণে, একজন ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে তাসনুভাই প্রথম ছোট পর্দায় সংবাদ পাঠ করেন। সপ্তাহে দুই দিন করে নিয়মিত খবর পড়ছেন তাসনুভা।

অক্টোবর ৯ কারওয়ান বাজারে এক ছাদ-রেস্তোরাঁয় অধুনার পক্ষ থেকে কথা হয় তাসনুভার সঙ্গে। তোলা হয় ছবিও। সেদিন বিকেলে ছিল মুষলধারায় বৃষ্টি। বৃষ্টি থামার পর রেস্তোরাঁয় বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

কী খাবেন? কফি আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই?

: আলু খাই না। কফি চলতে পারে।

আলু না কেন?

: কার্ব খেলেই আমার ওজন বেড়ে যায়। তাই খাবারদাবারের ব্যাপারে খুব সচেতন থাকতে হয়।

তাসনুভার ক্ষেত্রে এমন সচেতনতা স্বাভাবিক। প্রায় তিন সপ্তাহ চিকিৎসা করিয়ে কলকাতা থেকে ফিরেছেন ২ অক্টোবর। তবে সরাসরি ঢাকায় নয়। ‘যশোরে ছিলাম কয়েক দিন। আমার নিজের সংগঠন শ্রী: ভয়েস অব সেক্সুয়াল মাইনরিটির হয়ে শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে কিছু কাজ ছিল। সেগুলো শেষ করে এলাম ঢাকায়।’ বললেন তাসনুভা। তাসনুভার এই সংগঠন কাজ করে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের অধিকার আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে।

১৯৯১ সালের ১৬ জুন বাগেরহাটের মংলায় জন্ম তাসনুভা আনানের, শামসুল হক ও জামিরুন বেগমের ঘরে ছেলে হিসেবেই। তখন তাঁর নাম রাখা হলো কামাল হোসেন। ছয় ভাইবোন তাঁরা। কামাল হোসেনের বয়স যখন ছয়-সাত বছর, তখন থেকেই তাঁর শারীরিক বিষয়টি নজরে আসতে শুরু করে পরিবার ও আশপাশের মানুষের। মেয়েলি হরমোনের প্রভাব বেশি। ছেলের শরীরে যেন এক নারী।

‘নাচ দিয়ে আমার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের শুরু। ছোটবেলা থেকেই নাচি। তখন মনে হতো নাচের কারণেই আমি হয়তো এমন।’ বলেন তাসনুভা। কিন্তু ধীরে ধীরে মেয়ে সত্তা প্রবল হতে থাকে। মনে-প্রাণে সে-ও তখন নারী হয়ে উঠছে। এর মধ্যেই ২০০৬ সালে এসএসসি পাস করলেন। ‘বাড়িতে আর থাকতে পারলাম না। চলে এলাম নারায়ণগঞ্জে, চাচার বাসায়। সমস্যা সেখানেও।’ উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষ থেকে একা থাকা শুরু করলেন। সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হলেন। স্নাতকোত্তর পড়ার সময় নামে আনলেন পরিবর্তন, হলেন তাসনুভা আনান।

এদিকে দেশে চিকিৎসা শুরু হয়েছে তাসনুভার। ‘আমি সঠিক চিকিৎসা পাইনি। সাত মাস ধরে যে ওষুধ খেয়েছি, তাতে শরীর আরও খারাপ হয়েছে। ব্যাকপেইনে দিনের পর দিন হাঁটাচলাও করতে পারিনি। কলকাতায় আমাদের কমিউনিটির কয়েকজন বন্ধুর মাধ্যমে চিকিৎসা নেওয়া শুরু করি। সঠিক চিকিৎসায় ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হতে থাকি। তবে পরিবর্তনের যে চিকিৎসা, তা দীর্ঘমেয়াদি। এখনো যা চলছে।’ বললেন তাসনুভা।

নিজেকে এগিয়ে নিতে সংস্কৃতির অঙ্গন বেছে নিলেন তাসনুভা। নাটকের দল নাটুয়া দিয়ে মঞ্চে অভিনয় শুরু। এখন আছেন বটতলা দলে। এ বছরই কসাই সিনেমায় অভিনয় করেছেন। কলকাতার প্রামাণ্যনাটক টেগোর সংস-এ অভিনয় করেছেন। চলমান তালিকায় এখন আছে আরও নাটক-সিনেমা-তথ্যচিত্র।

মডেলিংয়ের শুরু দ্য ডেইলি স্টার-এর ক্রোড়পত্র লাইফস্টাইলে। ‘এটা বের হওয়ার পর সবাই খুব প্রশংসা করলেন। আমাদের শিল্পে কিছু ধারা আছে। মেয়ে মডেল হলে শারীরিক গড়ন এমন হবে, ছেলে হলে এমন। ডেইলি স্টার-এর সেই ফটোশুটের পর দৃষ্টি কাড়তে পারলাম। আমি কখনো চাই না টাইপড কোনো চরিত্রে অভিনয় করতে। অভিনয়শিল্পীরা যেমন নানা চরিত্রে অভিনয় করেন, আমিও তেমনটা করি।’ এ কারণেই ট্রান্স চরিত্রের পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দেন তাসনুভা।

নিজের জন্যই ফিটনেসের ব্যাপারে খুব সচেতন থাকতে হয় তাসনুভাকে। ‘কার্ব খাই না। সারা দিন লেবুর রস আর গরম পানি পান করি। নির্দিষ্ট ডায়েট চার্ট মেনে চলি। সকালে ১০-১৫ মিনিট করি যোগব্যায়াম।’

সাক্ষাৎকারের আগে যখন যোগাযোগ হচ্ছিল, তখনই তাসনুভা জানিয়েছিলেন শাড়ি তাঁর খুব পছন্দ। খুব ঘুরতে পছন্দ করেন। ‘পাহাড় আর সমুদ্রে যেতে বেশি ভালো লাগে। আর এই ঘোরাটা আমি করি একাই।’

ট্রান্স—এ কারণেই মনের ওপর চাপটা বেশি। মন শান্ত রাখেন কীভাবে?

মাঝেমধ্যে ধ্যান করি। তবে কাজ করে করেই মন শান্ত রাখি।

মন যেহেতু আছে, আবেগও তো আছে। প্রেমে পড়েছেন কখনো? তাসনুভার ঝটপট উত্তর—পড়িনি, প্রেম করেছি। এক, দুই, তিনটা। প্রথম প্রেম একজন শিক্ষক, দ্বিতীয় নাটকের একজন আর তৃতীয় প্রেম করি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার সঙ্গে।

তারপর?

তাসনুভা বলেন, ‘তিন প্রেমে ছয় বছর চলে গেছে। প্রথম প্রথম সবাই ঠিক থাকে। পরিণয় প্রসঙ্গ এলে তখন সমাজ কী বলবে? পরিবার মেনে নেবে না…ইত্যাদি। আমাদের পুরুষেরা বেশির ভাগই হিপোক্রেট। একজনের সঙ্গে প্রেম করে আবার আরেকজনকে ভালোবাসে। তাই এখন আর প্রেম নিয়ে ভাবি না। “ফোকাস অন ক্যারিয়ার”-নিদেনপক্ষে ফোকাস অন স্টেজ। তিনটা ছেলের সঙ্গে ছয় বছর প্রেম না করে এই সময়টা মঞ্চে দিলে আরও বেশি ভালো করতাম।’

ভালো চাকরি করতেন তাসনুভা। মঞ্চ আর অভিনয়ের কারণে সেটা ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ, তাসনুভা চান মূলধারার শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। আলাপের শেষ দিকে ঘড়ি দেখছিলেন বারবার। ‘আজ আমাদের বটতলার নাটকের শো আছে। আমাকে সময়মতো যেতে হবে।’

সেখানে যেতে তো তাঁকে হবেই, তাসনুভার প্রাণের টান তো সেখানেই।

সংবাদটি সম্পন্ন দেখুন : https://www.prothomalo.com/feature/adhuna/মূলধারায়-একজন-শিল্পী-তাসনুভা/